ফিচার : অপসংস্কৃতির কবলে ঈদ উৎসব
ওয়াহিদ জামান
ঈদের ৩য় দিন। বিকেল ৫টা ৩০। বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায়। হাঁটছি। হাঁটার উদ্দেশ্যেই হাঁটছি। এভাবে মিনিট বিশেক। পৌঁছলাম মুড়াপাড়া ফেরীঘাট। এখান দিয়ে বয়ে চলা নদীটির নাম শীতলক্ষ্যা। সেই শীতলক্ষ্যা। যেখানে মাঝে মধ্যেই ভেসে ওঠে অজ্ঞাতনামা লাশ। ক্ষত-বিক্ষত লাশ। বস্তা-বন্দি লাশ।বুঝতেই পারছেন, এটা গুমরাজ্য নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। ফেরীতে উঠে পড়লাম। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর নদীটির দুই ধারে সারি সারি নৌকা। শোভাবর্ধনে ভাসমান শেওলা, যেন সাঁতরে বেড়াচ্ছে নদীর এপার ওপার। নদীর কূল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ফিরফিরে বাতাসে হালকা ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে কূলে। কয়েক মিনিটেই নদী পার হয়ে ওপারে। আগেই বলেছি হাঁটার উদ্দেশ্যেই বের হয়েছি। তাই গাড়িতে উঠার চেষ্টা না করেই হাঁটছি। রাস্তার বাম পাশ ধরে হাঁটছি আর দেখছি। আঁকা-বাঁকা রাস্তা কিছুটা ভিতরে ঢুকে আবার এসে মিশেছে নদীর ধারে। এখানে ফেরী নেই। আছে ছোট ছোট নৌকা। এরা অবশ্য এটাকে নাও বলে। ঘাট ওয়ালার দুই টাকা আর মাঝির দুই টাকা, এই চার টাকাতেই নদী পার। তারপর হাঁটছি নদীর ধার ধরে ডান দিকে। কিছুদূর যেতেই উচু গম্বুজ, স্থাপত্যশৈলী দেখেই বুঝা যায় হিন্দুদের মন্দির। আরেকটু সামনে গেলেই বামপাশে বিরাট আমবাগান। আমবাগানের মাঝে চারঘাট ওয়ালা পুকুর। পুকুরের পূর্বপাশে বৃটিশ স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি লালরঙা লম্বা দ্বিতল ভবন। এটি মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ী। বর্তমানে মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। বলতে পারেন দৃষ্টি নন্দন স্থাপনা। এখানেই গত বছরের শুরুতে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির সুট্যিং হয়েছিল। কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে ফটোসেশন করলাম। তারপর মাগরিবের আযান। নামাজ শেষ করে একই রাস্তা ধরে বাসার পথে। হাঁটছি আর ভাবছি। সুন্দর একটি বিকেল উপহার দিলেন আল্লাহ। শুধু একটি বিষয় বিরক্তিকর। বার বার ভাবিয়ে তুলেছে আমাকে। সেটি হল অর্ধ-আবৃত নারী। অর্ধেক খালি গ্লাসকে অর্ধেক পূর্ণ গ্লাস বলতে পছন্দ করি। তাই এমন করে বললাম। নইলে অর্ধ-নগ্ন নারীই বলতাম। অনেকে হয়তো ভাবছেন, আমি বুঝি নারী বিদ্বেষী বা নারী স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। কিন্তু না। সেরকম হলে মহলে আবদ্ধ মহিলা বলেই সম্বোধন করতাম। তা না করে নরের অর্ধাঙ্গী নারী বলেই সম্বোধন করলাম।
২.
১৪৩৭ বছর আগে। তখন আরবের মানুষের দ্বারে দ্বারে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছে দিচ্ছিলেন মহামানব হযরত মুহাম্মদ স.। এক পর্যায়ে মক্কার কুরাইশরা বুঝতে পারলো- এটা মানবতার জন্য কল্যাণকর হলেও তাদের কর্তৃত্ব বা রাজত্বের জন্য হুমকি। ফলে তারা ইসলামের অনুসারীদের উপর শুরু করলো অসহ্য নির্যাতন। নির্যাতনের মাত্রা দিনকে দিন বাড়তে থাকলো। জীবন ধারণ করা অসম্ভব হয়ে উঠলো রাসুল স. ও সাহাবায়ে আজমাইনদের। অগত্যা সিদ্ধান্ত হলো- হিজরতের। জমি-জমা, ধন-সম্পদ, ঘর-বাড়ি সব ছেড়ে পাড়ি জমালেন মদীনায়। অন্যের জমিতে বসবাস করতে থাকলেন সবাই। জাগতিকভাবে বলা যায় কষ্টেই ছিলেন তাঁরা। সুখ-শান্তি-আনন্দ ছিল তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মদীনাবাসীরা তখন শরতের পূর্ণিমায় নওরোজ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় মিহিরজান নামে দু’টি উৎসব পালন করতো। উৎসব দু’টি প্রথমে ৬ দিন ব্যাপী এবং পরবর্তীতে ৩০ দিন ব্যাপী পালন করা হতো। নওরোজ ছিল নববর্ষ বরণের উৎসব। মিহিরজান ছিল পারসিকদের অনুকরণে আনন্দ উৎসব। জাহেলী ভাবধারা, স্বভাব, প্রকৃতি ও ঐতিহ্যানুযায়ী এ দু’টি উৎসব উদযাপিত হতো। অশালীন আনন্দ-উল্লাস, কুরুচিপূর্ণ রঙ-তামাসা ও হৈ-হুল্লোড় হতো এসব অনুষ্ঠানে। সমাজের বিত্তশালীরা নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হয়ে এ উৎসব পালন করতো। নারী-পুরুষের অবাধ মিলনকেন্দ্র ছিল এসব উৎসব। রাসূলুল্লাহ স. এসব আনুষ্ঠানিকতা দেখে দারুণভাবে ব্যথিত হন এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি মদীনাবাসীদেরকে এসব অশালীন, অন্তঃসারশূন্য ও লক্ষ্যহীন উৎসব পালন করা থেকে বিরত থাকার আহবান জানান। এর পরিবর্তে তিনি স্বমহিমা ও নির্মল আনন্দে ভাস্বর পবিত্র স্পর্শম-িত বহুবিধ কল্যাণধর্মী ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নামে দু’টি উৎসব পালনের জন্য নির্ধারণ করে দেন। সেদিন থেকে জাহিলিয়াতপূর্ণ ইসলাম পরিপন্থী নওরোজ ও মিহিরজান উৎসব চিরতরে বন্ধ করা হয় এবং তদস্থলে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উৎসবের প্রচলন করা হয়।
৩.
নওরোজ-মিহিরজান আর আমাদের দুই ঈদের মধ্যে মূল যে পার্থক্য তা হলো- ওদের অনুষ্ঠান দু’টি ছিল অশ্লীলতায় ভরপুর আর ধনিক শ্রেণির জন্য পালনীয়। অপর দিকে আমাদের ঈদ হলো অশ্লীলতামুক্ত এবং ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান মুক্ত। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় যে, পৃথিবীর আর কোন ধর্মে কিংবা জাতি-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উৎসবে মানুষের মৌলিক মানবাধিকারকে এমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর উৎসবে অপেক্ষাকৃত ধনিক ও বণিক শ্রেণির মানুষের মনোরঞ্জনকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। আর এই সব সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিত্তশালীরা আরও বিত্তবান হয়। গরীবেরা হয় আরও গরীব। অথচ ঈদ উৎসব গরীবদের সাথে নিয়ে পালন করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ঈদুল ফিতরের নামাজের পূর্বেই তাদের পাওনা তথা ফিতরা আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর ঈদুল আযহায় তাদেরকে কুরবানীর গোশত দেয়া হয় ধনীদের পক্ষ থেকে। বলা যায়- ঝর্ণা যেমন পাহাড়ের উচ্চতা থেকে নেমে অপেক্ষাকৃত নীচু ও সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে; ঠিক তেমনি ঈদের মাধ্যমে বিত্তবানদের নিকট থেকে অর্থসম্পদ গরীব মিসকিনদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রশমিত হয় ও ক্রমান্বয়ে দূরীভূত হয়। যার প্রদর্শন আমরা দেখেছি খোলাফায়ে রাশেদার ৩২ বছরের শাসনামলে। সেখানে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, যাকাত নেয়ার মত উপযুক্ত কোন গরীব মিসকীনকে খুঁজে পাওয়া যেত না। এ হলো ইসলামী সংস্কৃতির সোনালী ইতিহাস। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, রাসুল স.-এর সেই অশ্লীলতামুক্ত ও ধনী-দরিদ্রের সেতুবন্ধনের ঈদ কি আমাদের সমাজে আছে?
৪.
ঈদ উৎসবের নামে বহু আয়োজন থাকে চারিদিকে। টিভি চ্যানেলগুলোতে থাকে ১০/১৫ দিন ব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানাদি। যেমন- ঈদের নাটক, ঈদের নাচ, ঈদের গান, ঈদের কনসার্ট, ঈদের ফ্যাশন শো ইত্যাকার বিচিত্র সব অনুষ্ঠান। আর এসব অনুষ্ঠানগুলোতে থাকে অশ্লিলতার ছড়াছড়ি। কোথাও কোথাও দেখা যায় ঈদমেলা। সেখানেও চলে অশ্লিলতায় ভরপুর যাত্রা, পুতুলনাচ ও জুয়া খেলার আসর। ঈদের সাথে এসবের আদৌও কোন যোগসূত্র কি আছে? একশ্রেণির সংবাদপত্রও কম যায় না। ঈদের আগে থেকেই ঈদের নামে সপ্তাহে সপ্তাহে বের করে রঙিন ক্রোড়পত্র। তাতে যুবতী মডেলকন্যাদের নানা ঢংয়ের উগ্র ছবি ছাপা হয়। আর কেউ কেউ বের করে ঢাউস ‘ঈদ সংখ্যা’। এসব ঈদ সংখ্যায় খুঁজে পাওয়া যায়না ঈদ বা ইসলামের কোন ছিটেফোঁটা। বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া ঈদের কোন আলোচনা, ইসলামের মহিমা-শিক্ষা-দর্শনের কোন বিবরণ এসবে থাকে না। আমাদের নতুন প্রজন্মের মগজে এসব আবর্জনা ঢুকিয়ে দেয়া হয় ঈদের নামে। ঈদ যে রমজানের শিক্ষা- সংযম, ত্যাগ ও তৌহিদী চেতনায় উদ্যাপিত একটি ধর্মীয় আচার ও ইবাদতের অংশ, তা ভুলিয়ে দেয়া হয় কৌশলে।
৫.
আবহমান কাল ধরে বাঙালিরা উৎসবপ্রবণ। অল্পে তুষ্ট এ ব-দ্বীপের মানুষগুলো আনন্দের অনুসঙ্গ পেলে অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে যায়। তাই বলে অশ্লীল আর নিষিদ্ধ পথে তো পা বাড়ানো যায় না। কেননা, প্রত্যেকটি জাতি-গোষ্ঠীর আলাদা আলাদা আচার অনুষ্ঠান সে জাতির পরিচায়ক। এটা বলাই যেতে পারে দূর্গাপূজা দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায় কে চেনা যায়, বড়দিন দিয়ে খৃস্টানদের চেনা যায়, মাঘিপূর্ণিমার মাধ্যমে বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে চেনা যায়। এমনিভাবে ঈদ দিয়ে মুসলিমদের চেনা যায়। সুতরাং ঈদ উৎসব পালনে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার। পরিশেষে কামনা করছি, ঈদ আমাদের ঘরে ঘরে বয়ে আনুক শান্তি ও সমৃদ্ধির স্পন্দন। ঐক্য, সংহতি ও ঈমানের আলোকোজ্জ্বল পথ ধরে আমরা যেন এগিয়ে যেতে পারি। ঈদের আনন্দ হোক সবার আনন্দ।