19 Jun 2016

বাবা অনেক বড় অভিনেতা

ছোটবেলায় বাবার হাতে মার খেয়েছি বহুত। একটু দুষ্টু হয়তো ছিলাম। সবসময় ধরা পড়তাম না। তবে যেদিন ধরা পড়তাম সেদিন আর রেহাই হতো না। তখন মনে হতো- বাবা এতো নিষ্ঠুর কেন! মানুষের বাবারা তো এতো খারাপ না! সব মিলিয়ে বাবাকে খুবই ভয় পেতাম। বাবা বাড়িতে থাকলে একেবারে শান্ত হয়ে যেতাম। বাবার সামনে জোরে কথাও বলতাম না।
তিনি বাড়িতে বেশিক্ষণ অবস্থান করুক মনে মনে সেটাও চাইতাম না। তখন বুঝতাম না বাবা আদোও আমাকে ভালোবাসেন কিনা। তবে যেদিন থেকে বাড়ির বাহির হয়েছি সেদিন থেকে আস্তে আস্তে বাবার ভালোবাসা টের পেয়েছি।

আজ বাবা দিবস। ঘটা করে দিবস পালন করে বাবার মূল্যায়ন করা সম্ভব না। তবুও স্মৃতিপটে অনেক ঘটনা ভেসে উঠছে। সেখান থেকে দু/একটা লিখছি- 

১. গত বছরের শেষের দিকে আমার মোবাইল ফোনটা নষ্ট হয়ে যায়। মেরামত করার জন্য সার্ভিসিং সেন্টারে দিয়েছিলাম। কিন্তু খবরটা বাসায় জানানো হয়নি। এ অবস্থায় দু’দিন পার হয়ে যায়। বাবাতো মোবাইল করে করে না পেয়ে আমার সাবেক রুমমেট ও বন্ধুদের যাদের ফোন নম্বর তাঁর কাছে ছিল সবায়কে ফোন দিয়ে খুঁজেছেন। তাদেরকে বারবার ফোন দিয়ে খোঁজার অনুরোধও করেছেন। তখন দেশে খুন-গুমের সংবাদ ছিল প্রতিনিয়ত। যে কারণে এক প্রকার হয়রান হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অবশেষে দু’দিনের মাথায় ফেসবুক মারফত বিষয়টা আমি জানতে পারি। তখন সাথে সাথে অন্য একজনের ফোন থেকে বাবাকে ফোন দেই। সালাম দিয়ে যখন জিজ্ঞেস করলাম- “আব্বা কেমন আছেন?” তখন একদম কেঁদে ফেললেন বাবা। বললেন- আগে বাবা হও, তারপর বুঝবে কেমন আছি। আমি পুরাই নির্বাক হয়ে গেলাম। সরিটাও বলতে পারিনি আমি।

২. ২০১৫ সালের মাঝামাঝি। সেদিন মধ্য সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মোবাইল ফোনটা বন্ধ হয়ে আছে। তাড়াহুড়ো করে সুইচ অন করলাম। সাথে সাথেই কয়েকটি খুদেবার্তা চলে আসলো। প্রথমটি বিকাশ থেকে, কে যেন ১০০০ টাকা পাঠিয়েছেন। ২য়টি মিস কল এ্যালার্ট সার্ভিস থেকে, বাবা ৩/৪ বার কল দিয়েছিলেন। কলব্যাক করলাম বাবার ফোনে। ফোন ধরেই রাগত স্বরে কিছু কথা বললেন। শেষের কথাটি বললেন -"জানো তুমি?, তোমার ফোন বন্ধ থাকলে আমার কেমন লাগে"। একথা বলার সময় তাঁর কণ্ঠ জড়িয়ে আসছিল, যেন কান্নার মতো মনে হলো। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলাম। কিছুই বলতে পারিনি। 

৩. ২০০৪ সালে দাখিল পাশ করে বাড়ি ছেড়েছি আমি। তখন খুলনা শহরের মাদ্রাসা হোস্টেলে থাকতাম। শহরের ছেলেদের সাথে তাল মেলাতে অনেক টাকাই লাগতো। যখন যা চাইতাম, বাবা কখনও না করতেন না। তখন আমাদের মোবাইল ছিল না। বাজারের এক ফোনের দোকান থেকে আমাদের হোস্টেলের এক বড় ভাইয়ের ফোনে কল দিতেন বাবা। কখনো দেখা যেত ঐ ভাই হোস্টেলের বাইরে অথবা আমি হোস্টেলের বাইরে। আমি পরে খবর পেলেও ফোন দিতে পারতাম না। কারণ বাবারতো ফোন ছিল না। একবার কোন এক দরকারে বাবা আমাকে দুই/তিন দিনেও পেলেন না। তারপর খবর পেয়ে বাড়ি গেলে বড় ভাই আমাকে ফোন কিনে দেয়ার প্রস্তাব দিলেন। সত্যি সত্যি ফোন কিনেও দিলেন আমাকে। সেটিই আমাদের বাড়ির প্রথম ফোন। অথচ সেসময়ে আমাদের মতো ফ্যামিলিতে ফোন কিনাটা অস্বাভাবিকই ছিল। মোটকথা আমাকে সামান্য কষ্টও করতে হয়নি কখনো। তারপর আলিম পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে ফিরে শুনলাম, আমাদের বিলের যে এক বিঘা জমি ছিল তা গোপনে বিক্রি করে দিয়েছেন বাবা। কাউকেই বুঝতে দেননি তিনি। আর এটা করেছেন একমাত্র আমার জন্যই। 

৪. তখন ক্লাস থ্রীতে পড়ি। পায়ে আঘাত লেগে প্রচন্ড রকম ফুলে গেছে। অসহ্য ব্যাথা করে সবসময়। গরম পানির ছ্যাকা দিলে হালকা উপশম হয়। কোন ওষুধেই কাজ হয় না। সেদিন নির্বাচনের দিন ছিল। আমাদের বাড়ির সাথের স্কুলটায় নির্বাচনের সেন্টার। বাবাকে অনেক সহায়তা দিতে হচ্ছে সেখানে। হঠাৎ ঘরে ঢুকলেন বাবা। আমি কেমন করে যেন বলে উঠলাম- ওরে ব্যাথা..., আর তখনি বাবা আমাকে নিয়ে বের হলেন থানা সদরের দিকে। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ৬ কিলো. দূরে বড় একটা নদী পার হয়ে যেতে হয়। সেখানে গেলে ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, সব পুঁজ হয়ে গেছে ভিতরে, এখনই অপারেশন করতে হবে। কিন্তু ঐ হাসপাতালে অজ্ঞান করার কোন ব্যবস্থা না থাকায় বাবা আমাকে নিয়ে খুলনা শহরে চলে গেলেন। সেখানে অপারেশনের আগে যখন বাবাকে বন্ডে সই করতে বললেন তখন বাবা নাকি কেঁদে ফেলেছিলেন। আমার কিছু হয়ে যাবে এটা ভাবতেই এমনটি হয়েছিল তাঁর। 

আরও অসংখ্য ঘটনা আজ স্মৃতির দুয়ারে হানা দিচ্ছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে- বাবা অনেক বড় অভিনেতা। কঠোরতার খোলসে ভালোবাসাকে মুড়িয়ে রেখেছেন সারা জীবন। এখন অনেক ভালোবাসি তাঁকে। কিন্তু বলতে পারিনি কখনো। আর হয়তো পারবোও না।