ছোট ভাই-বোনদের প্রতি ওয়াহিদ জামান এর খোলাচিঠি
কথা, কথা, কথা আর কথা। চলছে কথার ধুম। বাদ দিয়ে সব ঘুম। ঘরে বাইরে,
বারান্দায়, সিঁড়ির উপর, গোলাপ গাছের নিচে, এমনকি বাথরুমেও বইছে কথার বন্যা।
প্রয়োজনে হোক আর অপ্রয়োজনে হোক, চলছে তো চলছেই। তাও আবার সরাসরি নয়,
মোবাইলে। এখন নাকি মোবাইলের যুগ। মুহূর্তের মধ্যেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে
অপর প্রান্তে ভেসে যাচ্ছে কথার গাঁথুনী। তথ্যের আদান-প্রদান হয়েছে অনেক
সহজসাধ্য। কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য যে, মোবাইল কেড়ে নিয়েছে আমাদের আবেগ,
বর্তমান প্রজন্ম হারিয়ে ফেলেছে চিঠি লেখার সব ভাষা। চিঠি এখন বইয়ের পাতায়
মোড়ানো এক ইতিহাস। তাইতো চিঠি লেখার সেই পুরানো দিনকে স্মরণ করিয়ে দিতে
চিঠি লিখছি আমাদের ছোট ভাইবোনদের উদ্দেশ্যে।
প্রিয়,
আসসালামু
আলাইকুম। পরিবার থেকে কিছুটা দূরে আছো- এইটুকু মন:কষ্ট ব্যতীত আশাকরি পরম
করুণাময়ের অপার করুণায় ভালো থেকে ভালোভাবে লেখাপড়ায় এগিয়ে যাচ্ছো। বাইরে
থেকে বিদ্যার্জন করতে সর্বাবস্থায় পরিবারকে সঙ্গ দেয়ার লোভটুকুতো সংবরণ
করতেই হবে। জীবনের প্রয়োজনে এমনি বহু ত্যাগ তিতিক্ষা মানুষের জন্য
অপেক্ষমান। তোমরা এখন এক আবেগতাড়িত স্বপ্নীল সময়ের দ্বারপ্রান্তে। আবেগ
প্রণোদিত অনেক স্বপ্ন উঁকিঝুকিতে তোমাদের সাড়া পেতে অধীর হলেও সায় দেওয়া
একদম সমীচীন হবে না কিন্তু। সজাগ থেকো- জ্ঞানচর্চা কিংবা পাঠ বহির্ভূত কোন
ব্যাপারই যেন তোমাদের ভাবনার ডানায় ভর না করে। কি? এমনটি লিখলাম বলে কি মন
খারাপ করলে? তোমাদের উপদেশ দেয়ার মতো দৃষ্টান্ত আমি নই ঠিকই, তবুও একজন
শুভাকাংখী হিসাবে লেখার সাহসটুকু পেলাম। এমনি স্নিগ্ধক্ষণে স্বচক্ষে অনেক
প্রস্ফূটিত প্রায় পুষ্পকে ঝরতে দেখেছিতো সেই অভিজ্ঞতা টুকু শুধু ব্যক্ত
করার শুভ ইচ্ছা হলো। সময়ের হাতছানি, আবেগ কি আবেদন অনেক কিছু থাকবেই। তবে
সব কিছুর আগে জীবনের কর্তব্য।
তোমাদের হয়তো অঢেল সম্পত্তি নেই। তাই
হাজী মহসিন কিংবা মন্নুজান হতে পারবে না। কিন্তু তোমরাতো পারবে তিনদিন ধরে
না খেয়ে থাকা ঐ ভিখারীর মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে। এতেই তোমাদের মহত্ব।
এটাই তোমাদের কৃতিত্ব। তোমরা কি ভাবছ, এর চেয়ে ভালো বিষয়ে ভর্তি হতে পারলে
কতই না ভালো হতো। তাহলে একটু পেছনে ফিরে দেখ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে
সহপাঠীর ঘাড়ে হাত দিয়ে এক সাথে ক্লাস করতে যেতে সে এখন কোথায়? সম্ভবত মাদার
(Mother) পদে চাকুরী নিয়ে পুকুর ধারে থালা-বাসন পরিস্কার করতে ব্যস্ত।
কিংবা রিকসার প্যাডেলে ঘুরছে তার জীবন। অথচ তোমরাতো এখনও পড়ার টেবিলে বসে
আছো। ভাবনা কিসের? অনেক ভালো আছ তোমরা । পড়া মুখস্ত হতে দেরী হচ্ছে তাই
মেধার প্রতি ধিক্কার দিচ্ছ? তোমরা কি দেখনি, তোমাদের মতো অনেক মানুষ মাথার
সমস্যায় পাগলা গারদে অবস্থান নিয়েছে। এখনও তো তোমরা তাদের চেয়ে অনেক ভালো
আছো। সময় বেশি লাগলেও সমস্যা নেই।
তুমি কি তোমার চেহারা নিয়ে উদ্বিগ্ন?
তোমার কি মনে পড়ে? তুমি ট্রেনে চড়ে বাড়ি থেকে আসছিলে, একটি লোক তোমার কাছে
হাত পেতে সাহায্য চেয়েছিল। তারতো দুটি চোখ ছিল না। তুমি কি দেখোনি? একটি
লোকের দু’টি পা’ই ছিল না। কত লোকের হাত নেই। অনেকে আছে কথা বলতে পারে না,
শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আল্লাহ কি তোমাকে তাদের চেয়ে শতগুনে
সুন্দর করে সৃষ্টি করেনি? তবে প্রশংসা কর সেই আল্লাহর।
তুমি কি
শ্রেণীকক্ষে চুপ করে বসে থাকো? কেন? শিক্ষকরা তোমার ছাত্রত্ব বাতিল করে
দিবে বলে। নাকি ভদ্রতা কমে যেতে পারে ভেবে? তুমি কোন ভদ্রতার পূজা করো,
যেটা তোমাকে নিস্তব্ধ নিঃচুপ করে দেয়? আশ্চর্য! আমি ঐ ভদ্রতাকে ঠেলে ফেলি,
যেটা নাকি তারুণ্যের প্রতিবন্ধক। তুমি কোন কবির কাব্য পড়ো? যিনি সামান্য
বৃষ্টির ভয়ে দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে বলেন তার, নাকি যিনি সকল
বাধা-বিপত্তির শিকড় উপড়ে ফেলে হুংকার ছাড়েন-“থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো
এবার জগৎটাকে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে” তার? আমি মনে
করি শিয়ালের মতো গর্তে লুকিয়ে হাজার বছর বেঁচে থাকার চেয়ে সিংহের মতো গর্জন
দিয়ে এক ঘন্টা বেঁচে থাকা শ্রেয়।
তুমি কি জানো, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়
সত্য কোনটি? সে হলো মুত্যৃ। যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু হবেই। হয়তো বয়সের
ভারে নয়তো রোগে ভুগে। কিংবা কোন দূর্ঘটনায়। এইতো মৃত্যুর ধরন। কিন্তু এই
ধরনের মৃত্যুর মাঝে কি কোন সফলতা আছে? আর যদি তোমার মৃত্যু হয় ন্যায়ের পথে
সত্য-প্রতিষ্ঠায়? কতই না সুন্দর এই মৃত্যু! তাই না? সফলতা এখানেই। তুমি তো
একদিন এ পৃথিবীতে ছিলে না। সব কর্তৃত্ব ছিল তোমার পূর্ব পুরুষদের হাতে। এখন
তুমি আছো। আবার একদিন আসবে যেদিন তোমার অস্তিত্বই থাকবে না। তাই যত দিন
আছো সত্য পথে চলবে, সত্য কথা বলবে, সত্যের দিকে ডাকবে। যদিও সত্য কথা তিতা
লাগে। তবে সেটা সত্যকামীদের কাছে নয়, মিথ্যার ধারক-বাহকদের কাছে।
“যত
দিন বাঁচি, ততদিন শিখি”এই বিচারে আমরা আজীবনই ছাত্র। তারপরও ছাত্র জীবনের
একটা ধরাবাধা সময়সীমা আছে। আমরা এখন সেই সময়সীমার মধ্যেই। তাছাড়া পৃথিবীর
প্রতিটা ধর্মই বিদ্যার্জনকে উৎসাহিত করেছে। পবিত্র কোরআনের প্রথম নাযিলকৃত
আয়াতেই বলা হয়েছে “পড়”। হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে “ছাত্রনং অধ্যানং তপ”। তাই
আমাদের উচিত পড়াশুনায় মনোনিবেশ করা। তবে আমাদের জেনে রাখা দরকার- ভালো
পড়াশুনা করে হয়তো একজন ভালো ছাত্র হওয়া যায়, কিন্তু ভালো মানুষ হতে হলে আরও
কিছু করা প্রয়োজন। আর পৃথিবীতে ভালো ছাত্রের চেয়ে ভালো মানুষের দরকার
বেশী।
তুমিতো জানো জীবনটাকে গড়তে যৌবনে অনেক কিছুর সঙ্গে লড়তে হয়। সে
লড়াইয়ে তুমি জিতবে- এ বিশ্বাস আমার আছে। যাক সে কথা, তোমার মতো মেধাবীকে
এহেন অধিক লেখা অপ্রয়োজনীয়। আর অধিক লিখে তোমার মূল্যবান সময়ের অপচয় ঘটানো
ঠিক নয়। তোমার বন্ধু মহলের সবাইকে আমার শুভেচ্ছা সিক্ত সালাম। তোমার কাংখিত
সফলতার স্বর্ণদ্বীপে পৌঁছে যাও যথাসময়ে এই শুভ কামনায় আজকের মতো ইতি
টানছি।